জনমানবশূন্য ঝিনাইদহের মঙ্গলপুর গ্রাম! আবার বসতি চেষ্টা
কোটচাঁদপুর (ঝিনাইদহ) প্রতিনিধি:
ঝিনাইদহ জেলার কোটচাঁদপুর উপজেলার একটি বহুল আলোচিত গ্রাম মঙ্গলপুর।
কোটচাঁদপুর উপজেলা শহর থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার দূরের গ্রাম মঙ্গলপুর। সেখানে নেই কোনো জনবসতি। মঙ্গলপুর গ্রাম জুড়ে ধান, মুশুরি ইক্ষুসহ বিভিন্ন ফসলাদি আর ফলজ বাগান। রয়েছে বেশ কয়েকটি বসতভিটার ধ্বংসাবশেষ, রয়েছে পুকুর।
এ ব্যাপারে উপজেলার বলাবাড়িয়া গ্রামের ৯৫ বছর বয়স্ক খালেক খান বললেন, আমি নিজে মঙ্গলপুর গ্রামের মানুষশূন্য হওয়ার বিষয়ে খুব একটা জানি না। তবে বাপ-দাদাদের কাছে শুনেছি এক সময় এই মঙ্গলপুর গ্রামে মানুষ ছিল। তাদের অনেকের গোলাভরা ধান ছিল, গোয়ালে ছিল গরু। গ্রামটি প্রায় মানুষশূন্য হয়ে পড়ে আজ থেকে ১৫০ বছর আগে।
সর্বশেষ হাজরা ঠাকুর, নিপিন ঠাকুর এরা ৪-৫ ঘর মানুষ ছিল তিনি দেখেছেন। আজ থেকে ৮০-৮৫ বছর আগে তারাও ঘরবাড়ি ভেঙে অন্যত্র চলে যায়। তিনি বলেন, পরবর্তীতে এরা হয়তো মাঠের মধ্যে নিরাপত্তা বোধ করেনি সে কারণে চলে গেছে। ঘরবাড়ি ভেঙে আগে যারা গেছে তারা কী কারণে চলে গেছে এ সম্পর্কে তেমন কিছু তথ্য দিতে পারেননি। বলাবাড়িয়া গ্রামের মুক্তার আলী (৬৮) বলেন, শুনেছি মঙ্গলপুর গ্রামের মঙ্গল পাঠান নামের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন, তার নামেই গ্রামটির নাম মঙ্গলপুর। মঙ্গল পাঠানের তিন একর জমির উপর ছিল বিশাল বাড়ি। বাড়ির চতুরধারে উঁচু করে ৩০ থেকে ৪০ ইঞ্চি চওড়া মাটির প্রাচীর ছিল। পাশের পুকুরের উচু পাড়ে দাঁড়িয়ে নাকি বাড়ির ভেতরের কাউকে দেখা যেত না। ওই পরিবার ছিল ভীষণভাবে পর্দাশীল। বউ মেয়েরা কখনো বাইরের পুরুষের সঙ্গে দেখা দিতো না। ওই মঙ্গল পাঠান এখানেই মারা যান। তার কবরও রয়েছে এখানে। তিনি বলেন, শুনেছি ১২ জাতির বাস ছিল এ গ্রামটিতে। অত্যাচারিত হয়ে ওই গ্রামের মানুষ গ্রাম ছেড়েছে এমন কথাও কখনোই শুনিনি। তবে সঠিক কী কারণে ধীরে ধীরে মানুষ গ্রাম ছেড়েছে তার পিতাও বেঁচে থাকা অবস্থায় বলতে পারেননি বলে জানান তিনি।
তবে এ এলাকায় প্রচলিত আছে, এক সময় কলেরা গুটিবসন্ত ওই গ্রামটিতে ছড়িয়ে পড়ে। অনেক মানুষ ওই কলেরা গুটিবসন্তে মারা যায়। মৃতদের মধ্যে শিশুর সংখ্যা ছিল বেশি। গ্রামে বিভিন্ন জায়গা থেকে ডাক্তার, কবিরাজ, ওঝা নিয়ে এসে ঝাড়ফুঁক করাসহ গ্রাম বন্ধ করেও কলেরা গুটিবসন্ত নিয়ন্ত্রণে না আসায় ওই গ্রামে অনেকে মনে করতে থাকে কোনো দৈবশক্তির কারণে এমনটি হচ্ছে। তাদের বিশ্বাস জন্মাতে থাকে এ গ্রামে থাকলে তারাও বাঁচবে না। ভয়ে তখন মানুষ ওই গ্রাম ছাড়তে শুরু করে। ধীরে ধীরে মানুষজন ঘরবাড়ি ভেঙে যে যার মত ভারতসহ দেশের সুবিধামত জায়গায় যেয়ে বসবাস শুরু করে। সেই থেকে ওই গ্রাম মানুষশূন্য হয়ে যায়।
এই এলাকার ইউপি চেয়ারম্যান মিজানুর খান বলেন, মঙ্গলপুর গ্রামের জমিজমা সব পরবর্তীতে এ গ্রামের বসতিদের উত্তরসূরিরা বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে পার্শ্ববর্তী গ্রামের মানুষের কাছে বিক্রি করে গেছে। এখন মঙ্গলপুর গ্রামজুড়ে শুধুই ফল আর ফসলের মাঠ। তিনি বলেন, মঙ্গলপুর গ্রাম পর্যন্ত ১৮ ফুট চওড়া মাটির রাস্তা ছিল। বর্তমানে রাস্তাটি তিনি হেরিং করে দিয়েছেন। রাস্তাটি এখন শুধুমাত্র মঙ্গলপুর মাঠের ফসলাদি আনা নেয়ার কাজে ব্যবহার হয়। ওই গ্রামের রাস্তার পাশেই মসজিদের নমুনা পাওয়া যায়। সেখানে মাঠে কর্মরত কৃষকেরা নামাজ আদায় করেন। যে কারণে সেখানে পানির ব্যবস্থার জন্য টিউবওয়েল বসিয়ে দেয়া হয়েছে। চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান খান বলেন, এলাকাতে তেমন বয়স্ক মানুষ বেঁচে না থাকায় মঙ্গলপুর গ্রামের প্রকৃত ইতিহাস এখন আর কেউ বলতে পারবে না।
‘অমঙ্গলের’ মঙ্গলপুরে আবার বসতি হচ্ছে!
সরকারি নথিতে মঙ্গলপুর গ্রামটির নাম রয়েছে। আছে ফসলি জমি, পুকুর ও গাছগাছালি। কিন্তু সেখানে নেই মানুষের কোলাহল। জনশ্রুতি রয়েছে, ৬০-৭০ বছর আগে মঙ্গলপুর গ্রামে মানুষের মধ্যে ‘অমঙ্গল’ আতঙ্ক ভর করে। ভয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে যান বাসিন্দারা। সেই থেকে গ্রামটি মানুষশূন্য।
সেই মঙ্গলপুর গ্রামে নতুন করে মানুষের বসতি শুরু হতে যাচ্ছে। সরকারি প্রকল্পের মাধ্যমে সাতটি ভূমিহীন পরিবারের জন্য ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে সেখানে নির্মাণ করা হয়েছে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক।
ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলার এলাঙ্গী ইউনিয়নে মঙ্গলপুর গ্রামের অবস্থান। ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, মঙ্গলপুর গ্রামটি ৬৬ নম্বর মঙ্গলপুর মৌজায় অবস্থিত। এই মৌজায় একটিই গ্রাম রয়েছে। গ্রামে ২০৬টি খতিয়ানভুক্ত জমি আছে। কিন্তু কোনো পরিবার নেই। গ্রামটি নিয়ে ২০১৪ সালের ১১ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোয় “অমঙ্গল” আতঙ্ক, মানুষশূন্য মঙ্গলপুর’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
প্রায় ৭০ বছর পর আবার মঙ্গলপুর গ্রামে মানুষের বসতি গড়ে উঠতে যাচ্ছে। ভূমিহীনদের ঘর নির্মাণ প্রকল্পে গত মার্চে সেখানে ঘর নির্মাণ শুরু হয়েছে। কর্মকর্তারা বলছেন, ইতিমধ্যে ওই গ্রামে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণ করা হয়েছে। মাসখানেকের মধ্যে ভূমিহীনদের জন্য ঘর নির্মাণের কাজ শেষ হবে। পাশের বাগডাঙ্গা, পাশপাতিলা ও বলাবাড়িয়া গ্রামের সাতটি ভূমিহীন পরিবারকে এই ঘর দেওয়া হবে। তারা সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করবে।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মেহেরুন নেছা বলেন, মঙ্গলপুর গ্রামে সাতটি ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। কাজ প্রায় শেষের পর্যায়ে। এটা মুজিব বর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর উপহার। দীর্ঘদিন পর মঙ্গলপুর গ্রামে আবার মানুষের বসতি গড়ে উঠবে।
কোটচাঁদপুরের প্রবীণ ব্যক্তি মোশারফ হোসেন বলেন, ৬০-৭০ বছর আগে মঙ্গলপুর গ্রামে মহামারি আকারে কলেরা ছড়িয়ে পড়ে। এতে অনেক মানুষ মারা যান। আতঙ্কে অন্যরা আশপাশের গ্রামে আশ্রয় নেন। কিছু পরিবার ভয়ে গ্রাম ছেড়ে ভারতে চলে যায়।
এলাঙ্গী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ, কোটচাঁদপুর ও যশোরের চৌগাছা উপজেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম মঙ্গলপুর। কিন্তু এই গ্রামে কোনো মানুষ বাস করেন না। তাঁরা লোকমুখে শুনেছেন, অজানা আতঙ্কে মানুষ গ্রাম ছেড়ে চলে যান। গ্রামটির কথা বর্তমান প্রজন্ম প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। পরে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশের পর সবাই জানতে পারে।
চেয়ারম্যান আরও বলেন, সাতটি পরিবার ওই গ্রামে বসবাস শুরু করবে। আস্তে আস্তে গ্রামে আরও বসতি গড়ে উঠবে, এই প্রত্যাশা তাঁদের।